হিমু ও কিছু কথা
আমার সমস্যার কথা রুপাকে কি আমি বলতে পারি? আমি কি বলতে পারি - আমার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্য সারাদিন আমি পথে পথে ঘুরি। মহাপুরুষ হবার সাধনা করি. যখন খুব ক্লান্তি অনুভব করি তখন একটি নদীর স্বপ্ন দেখি। যে নদীর জল ছুয়ে ছুয়ে এক জন তরুণী ছুটে চলে যায়। এক বার শুধু থমকে দাড়িয়ে তাকায় আমার দিকে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ।
এই তরুণীটি আমার মা. আমার বাবা যাকে হত্যা করেছিলেন।
এই সব কথা রুপাকে বলার কোনো অর্থ হয় না। বরং কোনো-কোনো দিন তরঙ্গিনী স্টোর থেকে টেলিফোন করে বলি - রুপা, তুমি কি এক্ষুনি নীল রঙের একটা শাড়ি পরে তোমাদের ছাদে উঠে কার্নিশ ধরে নিচের দিকে তাকাবে? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। একটুখানি দাঁড়াও। আমি তোমাদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে হেটে চলে যাবো।
আমি জানি রুপা আমার কথা বিশ্বাস করে না, তবুও যত্ন করে সারি পরে. চুল বাঁধে। চোখে কাজলের ছোয়া লাগিয়ে কার্নিশ ধরে দাড়ায়। সে অপেক্ষা করে, আমি কখনো যাই না।
আমাকে তো আর দশটা ছেলের মত হলে চলবে না। আমাকে হতে হবে অসাধরণ।আমি সারাদিন হাঁটি। আমার পথ শেষ হয় না।গন্তব্যহীন যে যাত্রা তার কোনো শেষ থাকার তো কথাও নয়.”
― ময়ূরাক্ষী (হিমু)
হিমু সিরিজের প্রথম বইতেই হুমায়ূন আহমেদ এই প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়েছেন।পাগল বাবার খেয়াল, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার যদি তৈরি করা যায়, মহাপুরুষ কেন নয়? আসলেইতো মহাপুরুষ কেন নয়? কিন্তু প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে মহাপুরুষ কি? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে মহাপুরুষ হতে পথে পথে হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে হেঁটে বেড়ানো আবশ্যিক কেন? পথে না হেঁটে কি মহাপুরুষ হওয়া সম্ভব না? একজন সংসারী মানুষের পক্ষে কি মহাপুরুষ হয়ে ওঠা সম্ভব না?
আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি একটু গুগল মামার কাছে হাত পাতলাম। তিনি আমাকে জানালেন মহাপুরুষ হচ্ছে-
Great man; noble man; saint; prophet
মহাত্মা ব্যক্তি, পরমহংস, অসাধারণ শক্তিমান সাধু পুরুষ।
তাহলে মহাপুরুষ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যার আত্মা মহান, যার মধ্যে হিংসা নেই, অন্ধকার নেই, যিনি পবিত্র হৃদয়ের সাধু পুরুষ। কথা হচ্ছে এইরকম চরিত্রের অধিকারী হতে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হবে কেন? একজন সংসারী মানুষের পক্ষে কি এরকম গুণাবলী অর্জন করা সম্ভব নয়?এই প্রশ্নে আমার উত্তর হচ্ছে সংসারী হোক কিংবা ভবঘুরে, পবিত্র আত্মা হওয়া সম্ভব নয়। মানুষ মাত্রই তার মধ্যে আলোর পাশাপাশি অন্ধকার থাকবে।আর গৃহত্যাগ করলেই কি গৌতম বুদ্ধ হওয়া যায়? যদি যেত তাহলে গৌতম বুদ্ধরা যুগে যুগে সৃষ্টি হতো না?মজার ব্যাপার হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ নিজে একথা স্বীকার করেছেন। হিমুর বাবার কথামালা বইতে তিনি লিখেছেন-
বলতে চাচ্ছি মহাপুরুষ আমাদের মধ্যে নেই। নেই বলেই মহাপুরুষদের প্রতি আমাদের দুর্নিবার আকর্ষণ। ভিন্নভাবে বলতে গেলে দুর্বলতা মানবজাতি ঘৃণা করে কারণ দুর্বলতা আছে তার মধ্যেই। Mankind abhors timidity, because he is timid.
মহাপুরুষ কেমন হবে এই প্রশ্নের উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ কি বলছেন জানেন?
যে বস্তুর অস্তিত্বই নেই সেই বস্তু সম্পর্কে ধারনা করাও সম্ভব নয়!
মানে আমরা যা দেখিনা সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।যেহেতু মহাপুরুষ বলতে কিছু হয় না, তাই আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট ধার করে মহাপুরুষের একটা ধারনা তৈরি করি। যুগে যুগে পৃথিবীতে অনেক মহান মানুষ এসেছেন, অনেক মহান কাজ করে পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন সত্যি। কিন্তু মহান আত্মা? যে আত্মার পবিত্রতায় চারপাশ আলোকিত হয় এমন আত্মা? একবিন্দু অন্ধকার নেই এমন আত্মা? নাহ, এমন আত্মা আসে নি (যদিও একজন মুসলমান হিসেবে আমি সেটা মানি না। আমি মানি একজন এসেছিলেন, মহাপুরুষ পৃথিবীর বুকে। সেটা আমার ধর্মীও বিশ্বাস আপনি সহমত হতে বাধ্য নন)। মানুষ মাত্রই তার মধ্যে আলো আর অন্ধকারের সংমিশ্রণ থাকবে। মুদ্রার দুই পিঠ। তাহলে যেহেতু মহাপুরুষ বলতে কিছু নেই, সেহেতু হলুদ পাঞ্জাবি কিংবা খালি পায়ে হেঁটে বেড়ানো এগুলো সব বানোয়াট এবং ধার করা।হুমায়ূণ আহমেদ যেহেতু বলেছেন মহাপুরুষ হয় না, তাই একজন মহাপুরুষ কি করেন সেটা জানা সম্ভব নয়।
তাহলে তিনি কিছু কিছু জিনিস যুক্ত করে হিমুকে আলাদা করেছেন। হলুদ পাঞ্জাবি পড়িয়েছেন, খালি পায়ে পথে পথে হটিয়েছেন, অদ্ভুত কাজ করিয়েছেন। মহাপুরুষ আর সাধারণ পুরুষে পার্থক্য থাকতে হবে তো নাকি? তাহলে বলা যায় হিমুর উদ্দেশ্যহীন হাটার সাথে মহাপুরুষ হওয়ার সম্পর্ক নেই।
অনেক সমালোচকের মতে হিমু হচ্ছে ভাদাইম্মা। কাজকর্ম কিছু করবে না, নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে ভঙ ধরে পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াবে। এই ধরনের চরিত্রের সংস্পর্শ অতি অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। না হয় জীবনে উন্নতি সম্ভব না। হিমু কিশোর মনে জীবন সম্পর্কে বিশ্রী প্রভাব ফেলে।
আবার হিমু প্রেমীদের কাছে এই হেঁটে চলা হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য মানুষের প্রতিবাদ। আমরা স্বাধীন এটা একটা বিশ্রী মিথ্যা কথা। আমরা স্বাধীন এই বিশ্বাস দিয়ে আমাদেরকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।হিমু তাদের কাছে স্বাধীনতা। হিমু উদ্দেশ্যহীন হাঁটে পরাধীনতাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে।
তারমানে দেখা যাচ্ছে হিমু উদ্দেশ্যহীন হাঁটে কেন এর উত্তর একেকজন একেকভাবে দিচ্ছেন। লেখকের হিসেবে মহাপুরুষদের কোনও ইউজার ম্যানুয়াল নাই, একজন পাঠকের হিসেবে কাজকর্ম না করার ধান্দা তো আরেকজনের কাছে হিমু স্বাধীনতার হলুদ পতাকা।
তবে একজন লেখক কিন্তু কখনই নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করেন না। একটা বড় অংশ থাকে রহস্যে মোড়া। যুগে যুগে পাঠক আর সমালোচকরা এসব রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করেন, নতুন হাইপোথেসিস নিয়ে আসেন, থিউরি নিয়ে আসেন।সেসব থিউরি সবসময় ফেলে দেওয়া যায় না কারণ তাতে শক্ত যুক্তি থাকে।
তাই হুমায়ূন আহমেদ যতই বলুক মহাপুরুষ যেহেতু হয় না, তাই তার সম্পর্কে তার ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে ধারনা করা সম্ভব না, সেটা মানতে পাঠক বাধ্য নন। একজন পাঠকের কাছে লেখকের অবচেতনটাও আসে যেটা লেখক নিজে দেখতে পান না। তাই পাঠক কিন্তু সাধারণ ব্যাপার না।পাঠক আর তার ভাবনা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে যেই হুমায়ূন আহমেদ নিজে বলছেন মহাপুরুষের অস্তিত্ব নেই, আবার তিনিই বলছেন-
তোমার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তুমি কিছু মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষের সাক্ষাত পাইবে। অতি অবশ্যই তুমি তাহাদের নিকট হইতে সহস্র হাত দূরে থাকিবে। কারণ মহাপুরুষদের আকর্ষণী ক্ষমতা প্রবল।
যে বস্তুর অস্তিত্ব নেই তার দেখা হিমু কিভাবে পাবে? তবে মহাপুরুষের অস্তিত্ব নেই এটা তিনি উপন্যাসে বলেন নি। আবার মহাপুরুষের সাক্ষাত পাবে এটা উপন্যাসে বলেছেন। মানে এই কথাটা ফিকশনাল বলা যায়।হুমায়ূন আহমেদ নিজেই কি কিছুটা কনফিউজড ছিলেন নাকি মহাপুরুষ কনসেপ্ট নিয়ে? হতে পারে।
তবে চলার পথে আমরা অনেক আলোকিত মানুষের দেখা পাই, এই কথা কিন্তু সত্যি। তাদেরই আমরা মহাপুরুষ কিংবা মহামানব বলে দেই। হ্যাঁ তাদের আকর্ষণী ক্ষমতা প্রবল থাকে। কিন্তু তাদের আত্মা একদম একশত ভাগ বিশুদ্ধ থাকে এটা আমি মানতে নারাজ। তাদের ভিতরে আলোর সাথে অন্ধকার নেই সেটাও আমি মানতে নারাজ। তাহলে তারা মহাপুরুষ না। আর যদি তারা মহাপুরুষ হয় তাহলে জগতের সব মানুষই মহাপুরুষ এবং মহাপাষান্ড।
যে খুনি ডুবতে থাকা একটা কুকুরকে পানি থেকে তুলে জীবন রক্ষা করেছে সে মহাপুরুষ।
যে আলোকিত মানুষ বিরক্তিতে একটা কুকুরকে লাথি মেরেছে সে মহাপাষান্ড।
একবার Paradise Lost থেকে একটা Quote নিয়ে Presentation দিয়েছিলাম। এই প্রসঙ্গে শেয়ার করে ফেলি-
“The mind is its own place, and in itself can make a heaven of hell, a hell of heaven”
লিখতে এসেছিলাম হিমু কেন উদ্দেশ্যহীন হাঁটে। আর লিখলাম কত উদ্দেশ্যহীন কথা। মূলত বলতে চাচ্ছিলাম হিমু মহাপুরুষ না, আবার হিমু আমার আপনার মত একজন সাধারণ মানুষ না। হিমু নিজেই একটা কনসেপ্ট যাকে পথে পথে হাঁটতে হয়। মানুষ দেখতে হয়, জীবনকে খুব কাছে থেকে আঁকড়ে ধরতে হয়। যে খুব ভাল করে যানে পথে পথে খালি পায়ে হেঁটে শুদ্ধ কিংবা অশুদ্ধ হওয়া যায় না।শুধু অসংখ্য মানুষের সাথে মেশা যায়, অসংখ্য ধারনা দেখা যায়। জীবনের মানে খোঁজা যায়।
সব তরুণকেই সকালে ফুল ফর্মাল হয়ে কর্পোরেট যন্ত্রের কাঁচামাল হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। সব তরুণীকে গুলশানে সুইমিংপুলসহ একটা ডুপ্লেক্সে থাকার জন্য মিথ্যুক রাষ্ট্র যন্ত্রের সাথে জী হুজুরি করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। যদি এদের জীবন অর্থবহ হয়, তবে জীবন দেখা হিমুর হাঁটা উদ্দেশ্যহীন কেন? বরং বলা যায় হিমুর হাঁটা আরও বেশী উদ্দেশ্যপূর্ণ।
অসাধারন,অসাধারন , খুব বেশি অসাধারন।
উত্তরমুছুনকোরার জন্য আমি আজ এখানে। আর আপনি সব সময়ই খুব ভালো লিখেন।