নরওয়েজিয়ান উড: ভালবাসা আর মৃত্যু মিলেমিশে একাকার
Death exists, not as the opposite but as a part of life...আমি জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একজন বিশাল ভক্ত। তার লেখার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে যা আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। মুরাকামির সাথে আমার পরিচয় নরওয়েজিয়ান উড বইটির মাধ্যমে যেটি আমি এখন পর্যন্ত তিনবার পড়েছি এবং সামনে আরো কতবার পড়বো জানা নেই।
হারুকি মুরাকামি
বর্তমানে জাপানে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক নিঃসন্দেহে। এমনকি সারা বিশ্বে তার বইয়ের ব্যাপক
চাহিদা। যাই হোক নরওয়েজিয়ান উড ১৯৮৭ সালে জাপানে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এই বইটি মূলত
মুরাকামিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এনে বসিয়ে দিয়েছে। তিনি আজকে সুপারস্টার মূলত তার এই
বইটির জন্যেই।
আমি বর্তমানে
তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস কাফকা অন দ্যা শোর পড়ছি, শেষ হলে রিভিউ দেওয়া হবে। এছাড়া
আমি স্পুটনিক সুইটহার্টের রিভিউ ইতিমধ্যে দিয়েছি
আমার ব্লগে। চাইলে পড়ে দেখতে পারেন। তবে কেউ যদি মুরাকামি শুরু করতে চান, তার জন্য
আমার সাজেশান হচ্ছে, নরওয়েজিয়ান উড।কেনো? জানতে হলে সম্পূর্ণ রিভিউটি পড়ে দেখতে হবে।
উপন্যাসের নামকরন
করা হয়েছে বিখ্যাত ব্যান্ড দ্যা বিটলসের গান নরওয়েজিয়ান উডের নামানুসারে। মুরাকামির
বইতে আরেকটি চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে সঙ্গীতের ব্যবহার। তার সব বইতে আপনি অনেক গানের রেফারেন্স
পাবেন। তার গানের প্রতি ভালবাসা সীমাহীন।নরওয়েজিয়ান
উড গানটির কয়েকটি লাইন শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না-
"I once had a girl
Or should I say she once had me
She showed me her room
Isn't it good Norwegian wood?"
"I once had a girl
Or should I say she once had me
She showed me her room
Isn't it good Norwegian wood?"
গানটা ইউটিউবে
সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। যাই হোক মূল গল্পে ফিরে আসি।গল্পটির মূল চরিত্র তরু ওয়াতানবে।
বলা হয়ে থাকে এই উপন্যাসটি কিছুটা
আত্মজৈবনিক এবং তরুর
সাথে মুরাকামির নিজের কিছুটা ছাপ রয়েছে বলেও জানা যায়।যাই হোক নরওয়েজিয়ান উড গানটি যখনই তরুর কানে আসে সে তার বিশ বছরের জীবনের স্মৃতিতে কাতর হয়ে পড়ে। মধ্যবয়েসী তরু ওয়াতানবে প্লেনের সিটে বসে আছেন, হটাৎ
করেই নরওয়েজিয়ান উড গানটি কোথায় যেন বেজে
ওঠলো। তিনি ভেসে যান তার বিশ বছরের ডরমেটরির জীবনে।পাঠক ভেসে গেলো জাপানের ছোট একটা শহরের সেই সময়কার তরু ওয়াতেনবের জীবনে নিজে তরু ওয়াতানবে হয়ে।
তরুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন তরুনীর মুখ, একটা অপরুপ মায়াময় মুখ, নাওকো। বিশ বছরের সাধারনের মাঝে অসাধারণ একজন নারী, একটা অন্যরকম ভালবাসার উপখ্যান যেন। কে এই নাওকো আর কি হয়েছিল নাওকোর সাথে তরুর? এক কথায় গল্পটা বলে শেষ করতে
চাচ্ছিনা। এইটা পড়েই জানুন বরং তাতে বেশী ভালো লাগবে।
তরু ওয়াতানবে
আর দশজন বিশ বছর বয়েসী তরুনের চেয়ে সম্পূর্ন আলাদা ছিল। সে একটা
বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যে পড়াশুনা করতো। সাহিত্য কেনো পড়তো তা সে নিজেও জানতো
না। সে কি করতে চাইতো তাও সে জানতো না। কিছু একটা পড়তে হবে তাই সে বেছে নিলো সাহিত্যকে।
আর সবার সাথে সে ঠিকভাবে মিশতে পারতো না।সে সময় একটা ভয়াবহ অতীত থেকে বাঁচতে তরু তার
নিজের শহর ছেড়ে অন্য একটা শহরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তার অতীতের সাথে কোনো
ধরনের যোগাযোগ যেন না থাকে এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কি এমন ছিল তরুর অতীত? একটা বিশ
বছরের তরুনের কি এমন অতীত থাকে যেটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়?
তরুর কলেজ জীবনে
একজন মাত্র বন্ধু ছিল, যার নাম কিজুকি।কিজুকির প্রেমিকা ছিল নাওকো। তাদের সম্পর্কের
রসায়নটা ছিল চমৎকার। তার একসাথে বড় হয়েছে। একদম পিকচার পারফেক্ট কাপল যাকে বলে। তরু,
কিজুকি আর নাওকো মাঝে মধ্যেই একসাথে বসে আড্ডা দিতো। কিজুকি একজন চমৎকার ছেলে ছিল,
যেখানে যেতো সেখানেই মাতিয়ে রাখতো। সে ছিল তরুর একমাত্র বন্ধু। একদিন তরু আর কিজুকি
পুল খেললো একসাথে তারপর বাসায় গিয়েই কিজুকি আত্নহত্যা করলো। আত্নহত্যা করার মতো ছেলেই ছিলো
না কিজুকি।আর আত্নহত্যা করার মত কোনো কারণও ছিলনা তার।টাকা পয়সার অভাব কিজুকির ছিল না, না ছিল সম্পর্কে দোটানা, না অন্যকোনো অসুবিধা, তবু সে আত্নহত্যা
করলো। কারণ কি? কেনো তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু পর্যন্ত বুঝতে পারলো না কিজুকি মারা যাওয়ার প্লান করেছে?কিজুকির মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় তরুর পুরো জগত। আর সেই ধাক্কা
থেকে পালিয়ে বেড়াতে তরু চলে আসে অন্য এক শহরে অপরিচিত কতগুলো মুখের মাঝে।
আর সেখানেই তার
সাথে দেখা হয়ে যায় নাওকোর(কিজুকির গার্লফ্রেন্ড)। ধাক্কাটা তরু একা খায় নি, তার সাথে সাথে খেয়েছিল নাওকো। ভাবা যায় আমার প্রেমিক যাকে আমি সবচেয়ে ভালবাসি, সে মারা গিয়েছে, কিন্তু আমি টেরই পাই নি!তার মৃত্যুর কারণও নেই, নাকি আছে? হয়তো নাওকো পাঠকদের কারনের খুব কাছে নিয়ে যাবে, কে জানে। নাওকো আর তরু নিজেদের অতীত থেকে পালিয়ে
দূরে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু
তারা দুজনই তাদের অতীতকে ফিরিয়ে
নিয়ে আসলো একসাথে হয়ে। জীবনের খেলা বোঝা দায়! এখন এই শহরে তারা দুজনই দুজনের একমাত্র পরিচিত মুখা যারা একটা মৃত্যুর ধাক্কা একসাথে বহন করছে। নাওকো আর তরু বন্ধুর মতো একটা কিছু হয়ে পড়লো। প্রতি উইকএন্ডে উদ্দেশ্যহীন হেটে বেড়াতো শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তাদের কথাবার্তাও হতো না তেমন।শুধু
প্রতি রবিবার, ছুটির দিন তারা শহরের এই মাথা থেকে ও মাথায় হাটতে থাকতো। সামনে নাওকো, পেছনে তরু।কেনো হাটতো, সেটা পাঠকেই বের করতে হবে।
নাওকো চরিত্রটিকে
অসাধারণ বলবো নাকি সাধারণ বলবো বুঝতে পারছি না। মৃত্যু যেমন তরুকে নাড়া দিয়েছিলো তার
চেয়ে কয়েকগুন বেশী নাড়া দিয়েছিল নাওকোকে। আর সেই আঘাতে তার ভেতরটা চুরমার
হয়ে গিয়েছিল। তরু যদিও সামলে উঠেছিল, নাওকো পারছিলো না। কারণ এমন কারণ ছাড়া মৃত্যু
নাওকো আগেও একবার দেখেছিলো।
একসময় প্রেম হয়ে
যায় তরুর নাওকোর প্রতি কিন্তু নাওকো হারিয়ে যায়। তরুর ভালবাসা গভীর হতে থাকে কিন্তু
নাওকো লাপাত্তা। কি হয়েছিল নাওকোর? কোথায় গিয়েছিল সে? জানতে হলে Norwegian Wood পড়ার
বিকল্প নেই। আচ্ছা তাদের কি আবার দেখা হয়? সেটাও জানতে হলে পড়তে হবে।নাওকো কি তরুকে ভালবেসে ফেলেছিলো নাকি ভালবাসাটা একতরফা ছিল?
ইতিমধ্যে নাওকো
নেই, তরুর দেখা হয় মিদুরির সাথে। তার সাথে একটা ক্লাস করে মিদুরি।মিদুরি ছিল নাওকোর
একদম উল্টো। সাধারণ মেয়ে বলতে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে নাওকো, আর মিদুরিকে বিদ্রোহী
নারী বলা যায়। যা ইচ্ছা করছে, যা ইচ্ছা বলছে যেন একটা জীবন্ত জীবনের প্রতিছবি। তরু
আর মিদুরি কি প্রেমে পড়ে? পড়ে দেখুন। হয়তো পড়ে।
আর কিছু চরিত্র
মুরাকামি শিল্পীর মতো এঁকেছেন। যেমন স্ট্রম ট্রুপার, নাগাসাওয়া, রেইকো, হিতাসুমি। প্রতিটি
চরিত্র ছোট কিন্তু একেকটা চমৎকার গল্প বলে যায়।রেইকো যদিও ছোট চরিত্র নয়, আর রেইকোর
সাথে তরুর একটা অন্য ধরনের গল্প আছে, শেষটাই সেরা চমক আমার মনে হয়। স্ট্রম ট্রুপার
তরুর রুমমেট থাকে। তার কার্যকলাপ আপনাকে হাসাবে আবার একই সাথে কেমন যেনো একটা বিষাদে
ভরে তুলবে আপনার মন। মনে হবে স্ট্রম ট্রুপারের মতো একজন কেউ আসলে জীবনে দরকার। নাগাসাওয়া
তরুর খুব কাছের একজন বন্ধু হয়ে যায় ডরমেটরিতে। এই চরিত্রটি অসম্ভব রিয়েলিস্টিক, অসম্ভব
কঠিন। হিতাসুমি নাগাসাওয়ার প্রেমিকা থাকে। এই চরিত্রটি একটা বিশেষ কারনে আমার খুব প্রিয়।
সেটা বলবো না, পড়ার পর কোনো পাঠক ধরতে পারেন নাকি সেটা দেখতে চাই, যদি পারেন মন্তব্যে
জানাবেন।
আমি উপন্যাসটি
সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে এটুকু
বলি আমি যা বলেছি সেটা মাত্র
এক পার্সেন্ট। আরো নিরানব্বই ভাগ জানতে হলে আজকেই শুরু করে দিন। বইটা এই কোয়ারেন্টাইনের
সময়ে আপনাকে ভিন্ন একটা জগতে নিয়ে যাবে। শেষ করছি একটা প্রিয় উক্তি দিয়েঃ
No truth can cure the sorrow we feel from losing a loved one. No truth, no sincerity, no strength, no kindness can cure that sorrow. All we can do is see it through to the end and learn something from it, but what we learn will be no help in facing the next sorrow that comes to us without warning.
হ্যাপি রিডিং!
এই বছর পড়া সেরা বইগুলোর একটা এইটা। আমি অবশ্য বাংলা অনুবাদটা পড়েছি।
উত্তরমুছুনবাংলা অনুবাদটা কেমন করেছে জানা নেই। তবে ইংরেজি অনুবাদটা চমৎকার। একেবারে সাবলীল এবং সহজ।
মুছুনবাংলা অনুবাদ পিডিএফ ভার্সন কি পাওয়া যাবে?
উত্তরমুছুনআমার সংগ্রহে নেই। ধন্যবাদ।
মুছুন