(করোনার দিনগুলোতে মার্চ ২৯, ২০২০)
আমি করোনার দিনগুলোতে
শিরোনামে একটা সিরিজের মতো করতে চেয়েছিলাম যাতে অনেকবছর পরে কেউ একজন পড়ে বুঝতে পারে
কিভাবে ছিল আজকের ঢাকা শহরটা। কিন্তু আমি মনে হচ্ছে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। আগ্রহ হারানোটা
কি অযৌক্তিক? সারাদিন নিজ গৃহে বন্দি থাকা মানুষের বলার মতো গল্প আর থাকেইবা কি? যার
কারনে লেখার মাঝখানে এতদিনের গ্যাপ পড়ে গিয়েছে।
ঢাকা শব্দটা মুখে
নিলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রানবন্ততা। সকাল ছয়টা থেকে রাত একটা পর্যন্ত ঢাকা চলতে
থাকে দুর্নিবার গতিতে। অথচ আজ? গতকাল ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলাম রাত ৯.৩০ মিনিটে, আমার
কাছে মনে হলো যেনো রাত একটা বাজে। চারদিকে এত নিস্তব্ধতা। আমি ঢাকার এরকম নিস্তব্ধতা
বেশ উপভোগ করি, বিশেষ করে ঈদের সময় এমনটা দেখা যায়। কিন্তু গতকাল আমার কাছে ভীষণ অস্বস্তি
লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফেরা উচিত। মনে হচ্ছিলো এ আমার শহর না।
এ যেন কোনো হরর ফিল্মের সেট। আঁধারে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে কোনো ভয়ানক আত্না।
আমাদের দেশের
করোনার অবস্থা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।কোনটা ঠিক তথ্য কোনটা ভুল সেটা নিয়েও আমি যথেষ্ট
সন্দিহান। আদৌ আমরা কি সুস্থ আছি নাকি একেকজন মানব বম্ব হয়ে বসে আছি, সেই প্রশ্নের
উত্তর খুঁজতে গেলে মাথা নষ্ট হয়ে যায়।
রিক্সার ঢাকায়
রিক্সা নেই। রিক্সাচালক মামার বাসায় ভাত নেই। স্কুলের ছুটে চলা বাচ্চাদের দেখা নেই।
প্রেমিক প্রেমিকার অলস সময় কাটানো খুনসুটি নেই, প্রতি সন্ধ্যা তীব্র গতিতে নীড়ে ফেরা
নেই। কোন শহরে আছি, কে জানে।
তবে একটা মজার
ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল প্রকৃতি বেশ সাজছে। আমরা এই এতদিন ধরে প্রকৃতিকে কি ভয়াবহ ভাবে
নষ্ট করেছি ভাবা যায়। আজকাল আমি বাসায় বসে কিছু পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ পাই। সেদিন
দেখলাম বঙ্গপসাগরের কলাতলি পয়েন্টে ডলফিন আপন মনে খেলছে। গত বিশ বছরের নাকি এই দৃশ্য
দেখা যায় নি। আমাদের করোনার দিনগুলোর বন্দি দশায় প্রকৃতি মুক্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
আমরা এতদিন প্রকৃতিকে বন্দি করে রেখেছিলাম। আজকে প্রকৃতির কাছে আমরাই বন্দি।এক দিক
দিয়ে ভালই হয়েছে, কি বলেন? আশা করি আবার এসব যখন শেষ হবে, আমরা প্রকৃতিকে খেয়াল রাখা
শিখবো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা শিখবো। এই শিক্ষা যেন আমরা ভুলে না যাই।
ঢাকা শহরে আমি
এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশী মিস করছি টঙের চা। আমরা যদি কোনোদিন খুব উন্নত হয়ে যাই, আর
এই রাস্তার পাশের টঙগুলো আর না থাকে, ঢাকা মনে হয় তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে। টঙ দোকান
ঢাকা শহরের অস্তিত্ব। মনে হচ্ছে কতদিন টঙের কড়া লিকারের ঝাক্কাস করে বানানো এককাপ চা
খাই না। মনে হচ্ছে এই চা আর কিছুদিন না খেলে বোধহয় মরেই যাবো।
ঠিক জানিনা এই
অবস্থাটা কবে শেষ হবে। এভাবে বন্দি হয়ে থাকা খুবই ভয়াবহ। তবে আমাদের যাদের মায়েরা গৃহিনী
এবং যাদের কাজের আমরা দাম দেই না, এখন বোঝা উচিত তারা কিভাবে থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকা
হয়ে ঘুড়ে বেড়াই শহরে, নিজের মাকে শেষ কবে কোনো রেস্ট্রুরেন্টে নিয়ে গিয়েছি মনে করতে
পারি কি? কিংবা কোনো পার্কে? দিনের পর দিন মানুষটা আমাদের জন্য কোয়ারেন্টাইন কাটাচ্ছে
নাতো? যদি কাটায়, তবে এই ধাক্কা শেষ হয়ে গেলে সবার আগে মাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসুন। কারণ
এর ভয়াবহতাটা কিন্তু আমি আপনি আমরা সবাই টের পাচ্ছি।
করোনার নিউজ চারপাশে,
ভাল নিউজ বলতে গেলে কিছুই নেই। কেমন যেন দম বন্ধ লাগে, সবকিছুই কেমন যেনো ভাললাগে না।
তবে এই যে অবসর সময়টা পাওয়া গিয়েছে, এই সময়টা আসলে নিজেকে জানার জন্য সেরা। কিছু ভাল
ছবি দেখা যায়, কিছু সুন্দর বই পড়া যায়, কোনো একটা হারিয়ে যাওয়া পুরোনো অভ্যাসকে আবার
ফিরিয়ে আনা যায়। নিজেকে সময় দেওয়া যায় আর পরিবারের মানুষগুলোর সাথে বন্ডিংটা গভীর করার
এইতো সময়।
বাসায় থাকবেন,
ভাল থাকবেন এবং সবাইকে ভাল রাখবেন।
কোন মন্তব্য নেই