হতাশ হবেন না, এই অবস্থাটাও বদলাবে (This too shall Pass)
আমরা গৃহবন্দি তাও প্রায় চল্লিশ দিনের বেশী।সময় কি যাচ্ছে নাকি
থমকে গিয়েছে বোঝা মুশকিল।আজকাল মনে হয় শুক্রবার দুইদিন পর পর আসে।সবকিছু কেমন একটা স্তব্ধ, থমথমে। ঝড় শুরু হবার আগে প্রকৃতি যেমন থমকে যায় একদম তেমন। মনে হচ্ছে একটা
বড় কিছু শুরু হবে তার অপেক্ষা।চার দেয়ালে বন্দি আমরা হাঁসফাঁস করছি।ইট ভাঙা মেশিনের ক্লান্তিকর
একঘেয়ে শব্দের মতো মনে হচ্ছে জীবন জীবন। বিদঘুটে ঘটঘট শব্দ, শুনতে চাচ্ছি না তবু পাশে নতুন দালান বানানো হচ্ছে, না শুনে
উপায় নেই।
চারপাশটা কেমন যেন ফ্যাঁকাসে প্রাণহীন।নিয়ন আলোর মাঝে হাত মেলে
ধরলে নিজেকে যেমন রক্তশূন্য মনে হয়। দেশটাও তেমনি রক্তশূন্য যেন। রাতের ড্রাকুলা
তার চোখা দাঁত বসিয়ে শুষে নিয়েছে সমস্ত রক্ত। একটা প্রাণহীন নিথর শহর অপেক্ষায় আছে প্রাণ
ফিরে পাওয়ার।
শহরের বুকে মানুষের হট্টগোল নেই, চায়ের কাঁপে চামচের টুংটাং থেমে গিয়েছে কবে, রোজকার আড্ডায় তরুণদের দলের উচ্ছ্বাস নেই, বিকেলে এলোমেলো খেলায় মত্ত কিশোর দলেরও দেখা নেই কতকাল। কেবল চার দেয়াল আর আমাদের আত্মার মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।
আজকাল মনে হয় এই যাত্রার বোধহয় আর শেষ নেই। এই যাত্রা থামবে
না কোনদিনই।চারপাশ থেকে হতাশা আর দুশ্চিন্তা আঁকড়ে ধরছে। এভাবে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে
উঠছি আমরা সবাই।মনে হচ্ছে মুক্তির জন্য একটা বিদ্রোহ শুরু হল বলে। মন ইতিমধ্যে বিদ্রোহ
ঘোষণা করে দিয়েছে।
আমি এই অবস্থাটার একজন ভিকটিম। বুঝতে পারছি মনের উপর দিয়ে কি
যাচ্ছে। কিন্তু একটু অপেক্ষা করুণ।
আসুন একটু দৃষ্টিভঙ্গির খেলা খেলি।
চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুনতো আপনি জন্মেছেন ১৯০০ সালে । যখন আপনার বয়স ১৪, শুরু হল
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানব সৃষ্ট মহাপ্রলয়ের, হ্যাঁ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা বলছি যেটা শেষ হল আপনার
১৮তম জন্মদিনে আর পৃথিবীর বুক থেকে ২২ মিলিয়ন তাজা প্রাণ চিরতরে হারিয়ে গেল।
রক্তের সাগর আর লাশের স্তূপ। চারদিকে পোড়া মাংসের গন্ধ।এদিকে
ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গলিত পচা লাশ, কাটা হাত, পা আর মাথা। আপনার দিশেহারা প্রাণ
তখনো ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারে নি। এরমধ্যে সে বছরই ধরণীর বুকে আঘাত হানল স্প্যানিশ
ফ্লু যেটা চলতে চলতে গিয়ে থামল আরও বছর দুই
পর যখন আপনার বয়স ২০ বছর। দুই বছরে মারা গেল কতজন মানুষ কল্পনা করতে পারেন? ৫০ মিলিয়ন।
হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন, ৫০ মিলিয়ন। একেকজন মানুষ হয়ে গিয়েছিল মানববম্ব।আপনি কথা বলার সময়,
শ্বাস নিচ্ছেন শ্বাস ছাড়ছেন, এইটুকুই যথেষ্ট ছিল আপনার সামনের মানুষটিকে আক্রান্ত করতে।
অক্সিজেনের জন্য, একটুখানি বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসে নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে নিশ্চিহ্ন
হয়ে গেল ৫০ মিলিয়ন মানুষ, ভাবা যায়!
যখন আপনার বয়স ২৯, চূড়ান্ত হতাশা শুরু হয়ে গেলো তখনই। বেকারত্বের
হার ২৫% আর বিশ্বব্যাপী জিডিপি কমে যায় ২৭%! এই হতাশা চলতে চলতে গিয়ে থামে যখন আপনার
বয়স ৩৩! বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সাথে দেশটাও প্রায় ধ্বসে পড়ে। কাজ নেই, টাঁকা নেই, খাবার
নেই। চারপাশে কেবল কতগুলো ক্লান্ত মুখ, একটু কাজের জন্য একটু খাবারের জন্য এদিক ওদিকে
ঘুরছে।হাসি-ঠাট্টা? সে তো রূপকথার গল্প!
আপনার বয়স যখন ৩৯, শুনতে পাচ্ছেন আরেকটা মহাপ্রলয়ের ডাক, শুরু
হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।না, আপনি এখনো পুরোপুরি বুড়ো হয়ে যান নি।দেখার আছে আরও অনেক
কিছু!
আপনার বয়স যখন ৪১, আমেরিকা তখন সবকিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
আপনার ৩৯তম জন্মদিন থেকে ৪৫তম জন্মদিনের মধ্যবর্তী সময়ে ধরণীর বুক থেকে ৭৫ মিলিয়ন মানুষ
নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং হলোকাস্ট হত্যা করে আরও ৬ মিলিয়ন। আবার চারদিকে লাশ, গলিত পচা লাশ, রক্ত, কাটা হাত-পা।ইতিহাসের
সবচেয়ে ভয়ংকর পারমানবিক বোমা লিটলবয় আর ফ্যাটম্যান দেখিয়ে দিলো তার তাণ্ডব। মায়ের বুকে
তার সন্তান নেই, ছেলের কাঁধে হাত রাখতে তার বাবা নেই, শিশুর কাছে নেই তার পরিবার! শহর
নগর সব মাটির সাথে মিশে গিয়েছে।
৫২ তে এবার শুরু হয় কোরিয়ার যুদ্ধ, প্রাণ হারায় ৫ মিলিয়ন মানুষ। ৬৪ তে ভিয়েতনামের যুদ্ধ
শুরু হয়, চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে ।ওই সংঘর্ষ
প্রাণ কেড়ে নেয় প্রায় চার মিলিয়ন মানুষের।পৃথিবী তখন নিষ্প্রাণ মানুষে উপচে পড়ছে।চারদিকে
সাড়ি সাড়ি জীবিত আর মৃত লাশ। কে জীবিত আর কে মৃত পার্থক্য করা কষ্টসাধ্য। হবেই না বা
কেন? প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, স্প্যানিশ ফ্লু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ, ভিয়েতনামের
যুদ্ধ এই সমস্ত কিছু পাড়ি দিয়ে যারা নিশ্বাস নিচ্ছিল তারা আদৌ কতটা জীবিত ছিল কে জানে।
না হাঁপ ছাড়ার সময় হয় নি। এখনো আরও বাকি।
আপনি যখন আপনার ৬২তম জন্মদিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, আপনার জন্য
অপেক্ষা করছে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস যেটা স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) একটা গুরুত্বপূর্ণ
ঘটনা। যেটা হয়তোবা শুরু করে দিতে যাচ্ছিলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
যেমনটা আমরা জানি, আমাদের গ্রহের বুক থেকে প্রাণের অস্তিত্ব
মুছে যেতে পারতো চিরতরে। মহান নেতারা সেটাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। টিকে গিয়েছিলো মানবজাতি।
যখন আপনার বয়স ৭৫, অবশেষে শেষ হল ৬২ তে শুরু হওয়া সেই ভিয়েতনামের
যুদ্ধ, কত মা তার সন্তান হারিয়েছেন, কত সন্তান হয়েছেন এতিম তার হিসেব কি মিলেছে আজো?
সংখ্যাটা শুধু মৃত লাশের, কত জীবিত মানুষ মৃত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে খবর কেউ রেখেছে
কি?
একবার কল্পনা করুণ সেসব মানুষগুলোর কথা যারা ১৯০০ সালে জন্মেছিলেন। আপনি এত সব কিছু পাড়ি দিয়ে বেঁচে থাকতেন কিভাবে? ১৯৮৫ সালের একটা শিশু ভাবেনি তার ৮৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ দাদা দাদী বুঝতে পারবে বিদ্যালয়ে পড়া কতটা কঠিন আর চ্যালেঞ্জিং। তারপরেও সেই সকল দাদা-দাদী আর নানা-নানীরা উপরে উল্লেখিত সবগুলো বিভীষিকা পার করে বেঁচে ছিলেন।
এবার একটু নিজের দিকে তাকান! কয়দিন চলছে? ৪০ দিন? ৫০ দিন? বেশী কঠিন?
দৃষ্টিভঙ্গি একটা অসাধারণ শিল্প। চলুন চেষ্টা করতে থাকি আর ব্যাপারগুলোকে একটু ইতিবাচক ভাবে নি। আসুন স্মার্ট থাকি, একজন আরেকজনের সাহায্যে দূর থেকেও পাশে থাকি। এভাবেই আমরা এই ভয়ংকর সময় পাড়ি দিতে সক্ষম হবো। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো কোনও ঝড় চিরকাল টিকে থাকেনি। তাকে চলে যেতে হয়েছে, যেতে হয়। এই সময়টাও চলে যাবে।
আর একটু ধৈর্য আর কিছুদিনের দুরুত্ব।
তারপর আবার সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে, আমরা হারাবো বলে পা টিপে এগুতে যতই চেষ্টা করি, বাতি নিভবে না কখনোই। আবার আমাদের ভাবনারা শিমুল ডালে নীলচে আগুন জ্বালবে, আবার আমরা এই বিদায়ে দুঃখ বিলাস করবো অনিকেত প্রান্তরে বসে।আবার গুঞ্জন শুনবো এ পাড়ায় নীলা আসার, আবার জ্বলতে জ্বলতে সুইটির জন্য হাহাকার। নেমেসিসকে বলে দিন কথাগুলো খুব শীঘ্রই সুরে গাইতে পারবে আর কবে কবে করে চিৎকার করার কিছু নেই।আর হ্যাঁ আলো আবার খুঁজে পাওয়া যাবে চিন্তার কিছু নেই, ইতিমধ্যে চাঁদের আলো ঠিকানা পেয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস না হয় রাতের আকাশ দেখুন। সেই তুমির জন্য আমরা জাহাজীর মতো এই শহরে আবার ভেসে বেড়াবো, একাপাখি খুঁজে পাবে ভালবাসা মেঘের ঠিকানা।
দিস টু শ্যাল পাস!
সত্যি বলতে একটা। মেসেজ পেলাম,,সুখে থাকতে হলে অল্প কিছুতে সন্তুষ্ট থাকতে হবে,,মিছে দুনিয়া সাজানোর দরকার মনে করিনা,,তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কড়া নারে ঘরের দরজায়😥
উত্তরমুছুন